বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:০২ পূর্বাহ্ন
সোহেল সানি॥ শেখ ফজুলল হক মনি। বাকশালের অন্যতম সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। শেখ মনি দৈনিক বাংলার বাণীরও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। থাকতেন ১৩ নম্বরস্থ ধানমন্ডির বাড়িতে। ১৫ আগস্ট রাত ১২ টায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মাকে নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি।
‘বুজিকে নিয়ে আমার সঙ্গে চারটে খেয়ে যাও’, বললেও রাত বেশি তাই মামা মুজিবের কথা রাখতে পারেননি ভাগ্নে মনি। রাত একটায় বাসায় মা ও স্ত্রীকে নিয়ে খেয়ে নেন।
বেডরুমে পরশ-তাপস ঘুমিয়ে। বঙ্গবন্ধু সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবেন।এ কারণে শেখ মনি খুব ভোরে ঘুম হতে উঠেন। হঠাৎ চোখ পড়লো গেইটের দিকে।
দেখলেন আর্মির কিছু লোক। ত্বরিতগতিতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠেন। ছোটভাই শেখ সেলিমের স্ত্রী ফজরের নামাজ আদায়ের করতে উঠে দেখেন মনি ভাইকে।
ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মনি ভাই কি হয়েছে? জবাব না দিয়ে শেখ মনি বেডরুমে ঢুকে তড়িঘড়ি ফোন করছিলেন- কিন্তু এনগেইজড। একটু পরে ফোন বেজে উঠল। শেখ মনি ফোন ধরলেন। অপরপ্রান্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে ভেসে এলো- ‘সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়ি আক্রান্ত, ফোন রাখো, আমি দেখছি।
সোহেল সানি, লেখক
মূহুর্তে ৬/৭ জন সশস্ত্র সেনাসদস্য বাড়ির ভেতরে ঢুকালো। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো, কোথায় শেখ মনি? শেখ মনি বেডরুম থেকে বেরিয়ে বললেন, আমিই শেখ মনি, কি হয়েছে? একজন বললো, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ কেনো, কি অন্যায় করেছি আমি? এই ক্ষুব্ধ কন্ঠ শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন শেখ মনির চুলের মুঠি ঝাপটে ধরলো। দৃশ্য দেখে শেখ সেলিমের স্ত্রী ভেতরে গিয়ে স্বামীকে গিয়ে বলেন, কারা যেন মনি ভাইকে মারছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শেখ সেলিম ছুটে এসে দাঁড়ালেন ভাইয়ের পাশে। ততক্ষণে শেখ মনির আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিও এসে পড়েছেন। নীচে গান পয়েন্টের মুখে শেখ মনির ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ।
চুল ছেড়ে দিয়ে ঘাতকরা বললো, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। শেখ মনি বললেন, ঠিক আছে, আমি আসছি। এ কথা বলে একটু ঘুরে ঠিক যে মূহুর্তে শেখ মনি তার রুমের দিকে যেতে উদ্যত- ঠিক সেই মূহুর্তেই শুরু হলো ব্রাশফায়ার। সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
গুলি লাগলো শুধু শেখ মনি ও বেগম আরজু মনির গায়ে। অন্যরা সবাই অক্ষত। লোমহর্ষক সেই রাতের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি। ছাত্রলীগের এককালীন সাধারণ সম্পাদক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনির ভাই তিনি। তার স্মৃতিকথায়, ‘মনি ভাই ও ভাবীর রক্তধারায় সেদিন জামাকাপড় রঞ্জিত হয়েছিলো আমার। ভাগ্যক্রমে আমার গায়ে গুলি লাগেনি। লাগেনি আমার স্ত্রীরও। ঘাতকরা তাড়াহুড়ো চলে যায়। গুলির শব্দে পরশ-তাপসের ঘুম ভেঙে যায়। ওরা চিৎকার করে ওঠে। আমার মা চিৎকার করতে করতে রুম হতে বেরিয়ে আসেন। মা অজ্ঞান হয়ে রক্তধারার ওপর লুটিয়ে পড়েন। আমার বৃদ্ধ বাবা শেখ নূরুল হক মর্মান্তিক অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে এক দৃষ্টিতে মনি ভাইয়ের লুটিয়ে পড়া দেহের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনি ভাই রক্তাপ্লুত। দেহ তার নিথর নিস্পন্দ।’
ভাবীর দিকে চোখ ফেরাতে দেখি তার ঠোঁট নড়ছে। যন্ত্রণার আর্তিতে তিনি বললেন, ‘আমার পেট ছিড়েফুঁড়ে গেছে। কোমরে শাড়ির বাঁধনটা একটা একটু হালকা করে দাও।’
আমার স্ত্রী বাঁধন হালকা করে দেয়ার পর ভাবীর মুখ মেঝেতে এলিয়ে পড়লো। ভাবী বললেন, ‘আমাকে বাঁচান। আমার দুটা বাচ্চা আছে।’ পরশ-তাপস করুণ আর্তিতে মা বাবার মুখের কাছে মুখ রেখে কান্না করছিল। শেখ মারুফ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করলে শেখ জামাল রিসিভ করে।
জামালের কন্ঠে ভেসে আসে আমাদের বাড়িতেও গুলি হচ্ছে। শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভাষায় সেদিন আমি মারুফ ও শাহাবুদ্দিন পিজির (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) উদ্দেশ্যে রওনা হলাম মনি ভাই ও ভাবীকে নিয়ে। মারুফের গাড়িতে মনি ভাই, পথে মোস্তফা মোহসীন মন্টু গাড়িতে উঠে। আমার গাড়িতে ভাবী। গাড়ির পেছনে হর্নের শব্দ। ওই গাড়িতে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের গাড়িতে ছিলেন রমনা থানার ওসি আনোয়ার। মনি ভাইকে অক্সিজেন দেয়া হলো। ভাবীকে নেয়া হলো অন্য ওয়ার্ডে। জরুরি বিভাগের বারান্দায় পড়েছিলো নিহত মন্ত্রী সেরনিয়াবাত সাহেবের ১৪ বছরের গুলিবিদ্ধ কন্যা বেবী। একটু একটু করে নড়ছিল সে। কিন্তু বাঁচানো গেলো না।
মনি ভাইয়ের কাছে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম। ডাক্তার বললেন, উনি আপনার কে হন? বললাম আমার ভাই। দুঃখিত। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলাম না। পাথরচাপা বুকে দৌঁড়ে ছুটে গেলাম ভাবীর অবস্থা জানতে। বিশ্বাস ছিলো ভাবী হয়তো বেঁচে যাবেন। না তিনিও এই সুন্দর পৃথিবীতে অসুন্দরের হাতে বলি হয়ে পরপারে চলে গেলেন।
শেখ সেলিমের বর্ণনায়, শেখ মনির বুকে ও থুতনিতে তিনটি গুলির ক্ষত পাওয়া যায়। আরজু মনির পেট ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকেও গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে নিয়ে আসা হলো। কাজের লোক আলতাফের কাছ থেকে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা। হাসপাতালে থাকা আমাদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। আমাদের কাপড়চোপড় রক্তেমাখা। এ নিয়ে বাইরে বেরুলে বিপদ হবে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সেদিন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এসএম মনিরুল হকসহ কয়েকজন চিকিৎসক। তারা কাপড়চোপড় দিলেন। সেগুলো পরে বাইরে বেরুলাম। ফিরলাম বাসায়। মা-বাবাকে না পেয়ে পরশ-তাপস কান্না করছিল। পরশের বয়স তখন পাঁচ আর তাপসের সাড়ে তিন। পরক্ষণেই আমরা বাড়ি ত্যাগ করে অন্য বাড়িতে চলে যাই। সেই রক্ত বন্যার নীরব সাক্ষী হয়ে স্মৃতি রোমন্থন করা বড় কষ্টের। অশ্রু সে- তো শুকিয়ে গিয়ে মরু হয়ে গেছে। কালরাতে হারিয়েছি রক্তের সম্পর্কে গড়া একগুচ্ছ মানুষকে। হারিয়েছি আত্মার আত্মীয়কে। মামা বঙ্গবন্ধু, মামী, রাসেল ও কামাল-জামাল, নবপরিণীতা বধুদ্বয় সুলতানা ও রোজী রব সেরনিয়াবাত, ভাবী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের পুত্র আরিফ, কন্যা বেবী, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর শিশুপুত্র সুকান্ত, শেখ মনি আর কর্নেল জামিল। সেই ভয়াল নৃশংস মুহূর্তের বর্ণনা সেতো বুকে রক্তক্ষরণেরই এক বেদনা।
অনুলেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Leave a Reply